আদালত অবমাননাঃ মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ প্রসঙ্গে

>> Monday, July 19, 2010

ফরহাদ মজহার
source: http://sonarbangladesh.com/article.php?ID=3177

আমরা আদালত অবমাননা নিয়ে লিখবো। নানান সময়ে নানান ব্যক্তি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। আদালত, সংবিধান, আইন ও ইনসাফ যে দিক থেকেই দেখি না কেন, আদালত অবমাননা সংক্রান্ত প্রশ্নটির মীমাংসা সহজ কর্ম নয়। কেন নয় তার প্রধান কারণ আদালত অবমাননার প্রশ্নটি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাক ও ব্যক্তির স্বাধীনতার প্রশ্নের সাথে সরাসরি জড়িত। গণতান্ত্রিক সংবিধান এক দিকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে এবং বাক ও ব্যক্তির স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ায়; নাগরিকদের এই অধিকারগুলো রক্ষার দায়ও আদালত স্বীকার করেন। অথচ অন্য দিকে আদালতকে সতর্ক থাকতে হয় যেন নাগরিক ও মৌলিক মানবাধিকার এমন কোন সীমা লঙ্ঘন না করে, যাতে আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। শ্যামও রাখা চাই, কুলও ঠিক রাখতে হবে। এ টানাপোড়নের মধ্যেই আদালত অবমাননা সংক্রান্ত তর্কটি আদালত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও বিচারশাস্ত্রে আজ অবধি চলে আসছে। এর কোন পরিচ্ছন্ন মীমাংসা নাই। এক ধরনের জোড়াতালি দিয়ে এই ভাবে মীমাংসা করা হয় যে, যদি সংবিধানে দেওয়া অধিকার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা রাষ্ট্র বিশেষ ভাবে আদালতকে নিশ্চিত করতে হয় তাহলে আদালতের যে কোন কর্মকাণ্ড, রায়, সিদ্ধান্ত, সমালোচনা ও পর্যালোচনা করবার অধিকার নাগরিকদের আছে, তা স্বীকার করে নিতে হবে। তবে কোন বক্তব্য বা লেখালেখি আদৌ আদালতের অবমাননা হচ্ছে কি না, সেটা বিচারকরাই ঠিক করবেন। এই অস্বস্তিকর মীমাংসার মধ্য দিয়ে এটাই স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, আদালত পারতপক্ষে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে ‘আদালত অবমাননার’ অভিযোগ আনবে না। যদি কোন বিচারক মনে করেন কোন চলমান বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তবে বাধ্য হলে তিনি ‘আদালত অবমাননার’র অভিযোগ আনবার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। সেই এখতিয়ার তাঁর থাকবে। এর মধ্য দিয়ে তথাকথিত আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামোগত সঙ্কটটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক দিকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা আবার অন্য দিকে আদালতের সার্বভৌম এখতিয়ার ও ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখা এই স্ববিরোধিতার মধ্যে আধুনিক রাষ্ট্র ক্রমাগত খাবি খায়।

কিন্তু আমরা যে বিষয় নিয়ে কথা বলব, তা তত্ত্বগত ভাবে এত জটিল কোন বিষয় নয়। আমরা আলোচনা করব কিভাবে বাংলাদেশে চেম্বার জজের ভূমিকা আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। অবিলম্বে এর কোন বিহিত না হলে সমগ্র বিচারব্যবস্থা মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে, দেশে অনাচার ও নৈরাজ্য বাড়বে। মানুষ বিচার না পেলে বিচার বিভাগকে অবজ্ঞা করতে শুরু করবে। ফলে এই লেখাটি আসন্ন বিপর্যয় রোধ করবার জন্য প্রধান বিচারপতির প্রতি আমাদের মিনতি ও আবেদন হিশাবে পাঠ করলে আমরা খুশি হব। আমাদের এখনকার বিষয় সুনির্দিষ্ট ভাবে দৈনিক আমার দেশ ও তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ।
আমার দেশ ও তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সাথে সরাসরি জড়িত বলে একজন নাগরিক হিশাবে আমি এ বিষয়ে লিখতে বাধ্য হচ্ছি। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। সংবিধানের দেওয়া এ নিশ্চয়তার ওপর ভরসা করেই আমি লেখাটি লিখছি। দেখা যাক বর্তমান রাষ্ট্র নিজের নাগরিকদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়।

দুই
একুশে এপ্রিল ২০১০ তারিখে আমার দেশ পত্রিকায় চেম্বার মানে সরকার পক্ষে স্টে শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই লেখাটির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রিয়াজ উদ্দিন খান ও কাজী মাইমুল হাসান। দোসরা জুন ২০১০ তারিখে প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করীমের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, প্রকাশক হাসমত আলী, বার্তা সম্পাদক মুজতাহিদ ফারুকী এবং প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন। ৫ জুন সশরীরে তাদের আদালতে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়। ৫ জুন, ২০১০ তারিখে মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার থাকায় তিনি ছাড়া অন্য চারজন আদালতে হাজির হন। আদালত ৯ জুলাই সবাইকে হাজির হতে নির্দেশ দেন। ৯ জুলাই, ২০১০ তারিখে মাহমুদুর রহমান ছাড়া বাকি চারজন আদালতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মাহমুদুর রহমান আদালতের রুলের জবাব দেবেন বলে জানান। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আদালতের কাছে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না। এবং আসলে ক্ষমা প্রার্থনা করার মতো কোন অপরাধ তিনি করেননি।

মাহমুদুর রহমান ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা বিচার বিভাগের ইতিহাসে তো অবশ্যই, বাংলাদেশের ইতিহাসেও অক্ষয় হয়ে থাকবে। ক্ষমা প্রার্থনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি সারা দুনিয়ার মানবাধিকার কর্মীদের কাছে ‘বিবেকের বন্দী’ হিশাবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন এবং একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছেন। সেটা হচ্ছে বিচার বিভাগ নিজের অজান্তে নাগরিকদের নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের হাত থেকে রক্ষা না করে তাদের বরং নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। বিশেষত অভিযুক্তকে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে রিমান্ডে নেওয়া এবং অত্যাচার-নির্যাতন করে জোর করে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করবার অনুমতি দিচ্ছে কোন কোন বিচারক। বাংলাদেশ নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে (Convention against Torture and Other Cruel, Inhuman or Degrading Treatment or Punishment) স্বাক্ষর করেছে। নাগরিকদের এই ধরনের বিপদের মুখে বাংলাদেশের আদালত অল্প কিছু বিচারকের অদূরদর্শিতার কারণে তুলে দিচ্ছে কি না আন্তর্জাতিক ভাবে আজ সেই প্রশ্ন ওঠার ভয়ানক বিপদ তৈরি হয়েছে। মাহমুদুর রহমান যে নৈতিক শক্তির বলে আদালতের কাছে আমার দেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার কারণে বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই আমাদের এই লেখাটিকে আদালত যেন আদালতের মর্যাদা রক্ষার প্রয়াস বলে বিবেচনা করেন আমরা সেই মিনতি জানাচ্ছি।

তিন
আগেই বলেছি, একুশে এপ্রিল ২০১০ আমার দেশ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, ‘তাদের স্টাফ রিপোর্টারের বরাতে। প্রতিবেদনের শিরোনাম চেম্বার মানে সরকার পক্ষের স্টে!’ উপশিরোনাম ছিল ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে স্থগিত করা হোল হাইকোর্টের রায়’। আদালত এ প্রতিবেদনটিকে আদালতের অবমাননা হিশাবে বর্ণনা করেছেন। পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ইতোমধ্যেই কারাবন্দী। তার বিরুদ্ধে সরকার একের পর এক মামলা ঠুকেই চলেছে।

প্রথমেই ‘চেম্বার মানে সরকার পক্ষের স্টে’ লেখাটিতে কী ছিল পাঠককে আগে তা বোঝানোর চেষ্টা করা যাক। আমার দেশ বলছে, আপিল বিভাগের চেম্বার জজ মোজাম্মেল হোসেন হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা স্থগিত করেছেন। চেম্বার জজের অবশ্যই এ ধরণের স্থগিতাদেশ দেবার এখতিয়ার আছে। কিন্তু আমার দেশের প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি সেই আদেশ কিসের ভিত্তিতে দিয়েছেন? আমার দেশ সুস্পষ্ট ভাবে বলেছে, চেম্বার জজ এই নির্দেশনা দিয়েছেন এটর্নি জেনারেল অফিসের দেয়া মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। আমার দেশ’ খুবই স্পষ্ট ভাবে বলছে, অসত্য ও ভুল তথ্যের বিষয়টি চেম্বার জজের নজরে আনা হয়েছে। কিন্তু আদালতের দৃষ্টিতে বিষয়টি আনার পরেও কোন কাজ হয় নি। তিনি হাইকোর্টের নির্দেশনা স্থগিত করে দিয়েছেন। খুবই গুরুতর অভিযোগ। বিষয়টি আসলে কী?
সরকার বিরোধী দলের নেতাদের ওপর নানান ধরণের হয়রানি ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। তার একটি হচ্ছে তাদের অপছন্দের ব্যক্তিদের বিদেশ যেতে না দেয়া। গত ১৫ এপ্রিল মীর নাসিরউদ্দিন সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে যান, সেখানে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে সাড়ে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন। এরপর তাকে জানানো হয়, ‘উপরের ক্লিয়ারেন্স’ না থাকায় তাকে যেতে দেয়া যাচ্ছে না। অথচ সৌদি আরবে মীর নাসিরউদ্দিনের স্ত্রী, কন্যা ও বোনের কবর রয়েছে। ওমরা হজ্জ পালন, রাসূল সাঃ-এর রওজা জিয়ারত এবং তার স্ত্রী, কন্যা ও বোনের কবর জিয়ারতের ইচ্ছা ছিল তার। তার জন্য তিনি মাত্র এক মাসের ভিসা পেয়েছিলেন সৌদি দূতাবাস থেকে। যেতে না পেরে সংক্ষুব্ধ হয়ে বিদেশ যেতে বাধা দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিনি একটি রিট আবেদন করেন। সে আবেদন মোতাবেক গত ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া মীর নাসিরউদ্দিনকে সৌদি আরবে যেতে বাধা না দেয়ার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের স্থগিতাদেশ চেয়ে এটর্নি জেনারেলের দফতর থেকে চেম্বার জজের আদালতে আবেদন করা হয়। চেম্বার জজ আদালত ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন।

আমার দেশের অভিযোগের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। চেম্বার জজ আদালতে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত বা স্টে করা ক্রমাগত একটি নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আমার দেশ বেশ কয়েকটি নজির দিয়েছে।
একঃ এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য দুই ছাত্রকে ৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ জামিন দেন। জামিনের আদেশে বলা হয়েছিল, পরীক্ষা শেষ হলে তারা সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবার আত্মসমর্পণ করবে। জামিন আদালতের সার্টিফাইড কপিটি পৌঁছার পরও কারা কর্তৃপক্ষ তাদের মুক্তি দেয় নি। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে তাদের ফোন করা হয়েছে। এটাই নাকি তাদের মুক্তি না দেয়ার একমাত্র কারণ। এর ছয় দিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি চেম্বার জজ দুই পরীক্ষার্থীর জামিন স্থগিত করে দেন।

দুইঃ গত বছর ২৮ অক্টোবর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে রিমান্ডে পুলিশের হেজাফতে না নিয়ে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ নির্দেশ দেন। পরের দিনই হাইকোর্ট বিভাগের এ নির্দেশনা স্থগিত করে রিমান্ডে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট আদেশ চেম্বার জজ বহাল রাখেন। বাবরের আইনজীবীরা জানিয়েছিলেন বাবর অসুস্থ। চেম্বার জজের সামনেই এটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন, বাবর মারা গেলে হত্যা মামলা কইরেন।
তিনঃ একই ভাবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে নারায়ণগঞ্জের একটি বোমা হামলা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডের বৈধতা নিয়ে তিনি একটি রিভিশন আবেদন করেছিলেন। এ ক্ষেত্রেও হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ শুনানি শেষে তাকে রিমান্ডে পুলিশের হাতে না দিয়ে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন। চেম্বার জজের আদালতে হাইকোর্ট বিভাগের এ আদেশও স্থগিত হয়ে যায়।

চারঃ ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার আরিফকে রিমান্ডে পুলিশ হেফাজতে না নিয়ে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পুলিশ কাস্টডি থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কারাগারে নিয়ে আসার জন্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশনা উপেক্ষা করায় আদালত এটর্নি জেনারেলের দফতরের আইনজীবীকে তিরস্কারও করেছিলেন। এ আদেশকেও চেম্বার জজ স্থগিত করে দেন। অর্থাৎ পুলিশ কাস্টডিতেই জিজ্ঞাসাবাদের যে আদেশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেয়া হয়েছিল সেই আদেশই বহাল রাখা হয়।
পাঁচঃ বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বিদেশ যেতে বাধা না দেয়ার হাইকোর্টের আদেশ চেম্বার জজ আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। আরো গুরুতর অভিযোগ যে, বিভিন্ন মামলায় জামিন পাওয়া আসামিদের না ছাড়ার জন্য এটর্নি জেনারেল চেম্বার জজ আদালতের স্থগিতাদেশ চান। এতে তিন শতাধিক মামলার আসামির জামিন আর হয় না। অথচ জামিন পাওয়া যে কোন অভিযুক্ত নাগরিকের অধিকার।

আমার দেশ আরো বলেছে, জরুরি অবস্থার সময়ও দেখা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ আপিল বিভাগ স্থগিত করে দিতেন। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুযায়ী কোন মামলা আপিল বিভাগে যাওয়ার প্রক্রিয়া হিশাবে প্রথম চেম্বার জজ আদালতে উপস্থাপন করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ বা নির্দেশনার বিরুদ্ধে প্রথমে চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করা হয়। চেম্বার জজ সেই আবেদনের বিষয়ে যে কোন রকমের আদেশ দেয়ার এখতিয়ার রাখেন। এ ছাড়া আপিল বিভাগের কোন মামলার শুনানির তালিকাভুক্ত করতে বা শুনানির জন্য দিন ধার্য করতে প্রথমে চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করতে হয়। প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে চেম্বার জজ হিশাবে দায়িত্ব দেন।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন বিদেশ যেতে চান। কিন্তু তাকে যেন বাধা না দেয়া হয়, তার জন্য আগে থাকতেই তিনি হাইকোর্ট বিভাগের কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন। হাইকোর্ট বলেছেন, মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনকে আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া বিদেশ যেতে যেন বাধা দেয়া না হয়। কিন্তু চেম্বার জজ এই নির্দেশনা মানলেন না। তিনি হাইকোর্টের নির্দেশনাকে আমলে না নিয়ে সেটা স্থগিত করে দিলেন। অর্থাৎ অকার্যকর করে দিলেন। মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন এখন স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও নিজ দেশে বন্দী হয়ে আছেন। সাংবিধানিক দিক থেকে আদালত এটা করতে পারে কি না সে দিকটা এর ফলে এখন তর্কসাপেক্ষ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু আমার দেশের অভিযোগ আরও অনেক বেশি গুরুতর। সেখানে বলা হয়েছে, আদালতে এটর্নি জেনারেল অসত্য তথ্য দিয়েছেন। এটর্নি জেনারেলের দাবি, মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন নাকি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ছয় বছর সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত হিশাবে দায়িত্ব পালন করেন। অথচ কথাটি সত্য নয়। এই ভুল তথ্য দিয়ে এটর্নি জেনারেল প্রমাণ করতে চেয়েছেন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এটর্নি জেনারেলের আবেদনে দাবি করা হয়, মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সৌদি আরবে গেলে তিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুøনালের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবেন।

মীর নাসিরউদ্দিন জবাবে আদালতে জানিয়েছেন, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কখনোই তিনি কোন দেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন না। চেম্বার জজ আদালতে এটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন, মীর নাসিরউদ্দিন ১৯৯৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অথচ তখন জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ একসঙ্গে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। মীর নাসিরউদ্দিনের বক্তব্য হচ্ছে, তিনি মাত্র সোয়া বছর সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত ছিলেন, ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সালে উপরে উল্লেখ করা তারিখ পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহণের দিনই তাকে প্রত্যাহার করা হয়। অর্থাৎ চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কখনোই তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন না আর কখনোই তিনি ছয় বছর সৌদি আরবেও ছিলেন না।

অথচ এই অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে চেম্বার জজ আদালতে হাইকোর্ট বিভাগের রায় স্থগিত করে দেন­ ‘আমার দেশ’ পত্রিকার প্রশ্ন এখানেই। আরেকটি বিষয় রয়েছে। এটর্নি জেনারেল হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার কিছু বিষয়কে গোপন করেছিলেন। যেমন, হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায় পরিষ্কার ভাবে বলা রয়েছে, মীর নাসিরউদ্দিনকে যেন আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া বিদেশ যেতে বাধা দেয়া না হয়। অথচ, এটর্নি জেনারেলের দফতর থেকে চেম্বার জজের কাছে দায়ের করা আবেদনে আইনগত প্রক্রিয়ার বিষয়টি উল্লেখ না করে গোপন করা হয়েছে।

চার
‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষের স্টে’ এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের কারণে মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করা হয়েছে। তার চরিত্র যেন পাঠক বুঝতে পারেন, তার জন্য প্রতিবেদনটি আমরা আরেকবার পড়লাম। আমরা দেখছি, ‘চেম্বার মানে সরকার পক্ষের স্টে’ এবং ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে স্থগিত করা হোল হাইকোর্টের রায়’ প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে। যেহেতু ছয়টি কেস স্টাডি দেখিয়ে প্রতিবেদনটি প্রতিষ্ঠা করেছে, চেম্বার জজ আদতে সরকার পক্ষেই হাইকোর্টের নির্দেশনা বিভিন্ন সময় স্থগিত করেছেন। এই ধরণের সত্য তথ্য ও প্রমাণভিত্তিক প্রতিবেদন কিভাবে ‘আদালত অবমাননা’ হয় সারা দুনিয়ার মানবাধিকার কর্মীরা এখন তা বোঝার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। আদালতকে বরং সুস্পষ্ট বুঝতে হবে এই প্রতিবেদন মোটেও আদালতের বিপক্ষে নয়। বরং চেম্বার জজ আদালতের যে ক্ষতি করে চলেছেন এবং সামগ্রিক ভাবে বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন তারই সত্য প্রতিবেদন।

সাধারণ ভাবে আদালত অবমাননার অর্থ আদালতকে ছোট করা। প্রতিবেদনের কোথাও আদালতকে ক্ষুদ্র বা জনগণের কাছে ছোট করা কোন ইঙ্গিত বা ইশারা নাই। বরং হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রশংসাই আছে। আদালতের একটি বিশেষ বিভাগের কারণে বিচারব্যবস্থা দেশে-বিদেশে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে, তার প্রতি আদালতের নজর আকর্ষণ করাই ছিল প্রতিবেদনটির প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য। এই ধরণের প্রতিবেদন আদালত অবমাননা তো দূরের কথা বরং আদালতবান্ধব প্রতিবেদন।
নাগরিক হিশাবে আমরা বুঝতে চাই, আসলেই, আদালতের এই ক্ষেত্রে কিভাবে অবমাননা হোল? দেখা যাচ্ছে, আমার দেশ আদালত অবমাননা দূরে থাকুক বরং আদালতের সংবিধান রক্ষাকারী ভূমিকা, নাগরিকদের সুরক্ষা এবং আদালতের মর্যাদা রক্ষার পক্ষেই কলম ধরেছে। দ্বিতীয়ত, এই প্রতিবেদনের মধ্যে অসত্য যেমন নাই তেমনি ছয়টি নজির দেখিয়ে প্রমাণ করেছে চেম্বার জজ স্টে দিয়েছেন সরকারের পক্ষে, নাগরিকদের সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে। ‘আমার দেশ’ বিশেষ ভাবে এ কারণেই বিচলিত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেবার এমন একটি প্যাটার্ন চেম্বার জজের আদেশে ফুটে উঠেছে, যা শুধু আদালত নয়, বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। আমরা সকলে জানি, নির্যাতন ও ব্যক্তির অমর্যাদা হয় এই ধরণের অপরাধের বিরুদ্ধে আজ বিশ্ববাসী সরব। নির্যাতন ও ব্যক্তির প্রতি অমর্যাদাকর আচরণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনও রয়েছে। চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে শুধু নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মানবাধিকারই ক্ষুণ্ন করেন নি, বরং তাঁর সিদ্ধান্ত নাগরিকদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চারে বা নির্যাতন বিরোধী আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে আদালতকে অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। বাংলাদেশের আদালত আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে পড়ে গেল। চেম্বার জজ নিজেও পড়লেন। ভয়ানক বিপদের মধ্যে ফেলে দিলেন তিনি বাংলাদেশকে। নির্যাতন ও ব্যক্তির অমর্যাদা ঘটে এমন সব অপরাধের সাথে আদালত নিজেকে কি প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত করে ফেলছেন না? সেটা ভয়ানক বিপজ্জনক। আদালতের কাছে আমাদের মিনতি তাঁরা যেন এই ভয়ানক দিকটির প্রতি অবিলম্বে নজর দেন।

আমার দেশের প্রতিবেদন থেকে আদালত ইতিবাচক ভাবে সতর্ক হবার ইঙ্গিতই পেয়েছে। এখানে অবমাননার কোন প্রশ্নই ওঠে না। নির্যাতন ও ব্যক্তির প্রতি অমর্যাদাকর আচরণ হয় তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমাদের সকলের কাছে পরিষ্কার থাকা দরকার। রিমান্ডে নিয়ে পুলিশের হেফাজতে দেবার নাম করে অভিযুক্তদের নির্যাতন করা এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নানান অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করা আন্তর্জাতিক আইনের চোখে অপরাধ। অতএব হাইকোর্টের কোন আদেশ যেখানে কোন অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে নির্দেশ স্থগিত রেখে অভিযুক্তকে অকথ্য নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে অসহায় ভাবে ঠেলে দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে আদালতকে অবিলম্বে সতর্ক হতে হবে। অথচ আদালত এই ক্ষেত্রে সতর্ক না হয়ে উল্টা আদালত অবমাননার দায়ে আমার দেশকে অভিযুক্ত করছে। বড়ই বিচিত্র!

আগেই বলেছি মাহমুদুর রহমান এখন বিবেকের বন্দী। তিনি আদালত অবমাননার জন্য ক্ষমা না চাইবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার কারণে আজ সারা দুনিয়ার মানবাধিকার কর্মীরা তার পক্ষে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নির্যাতন ও মানুষের প্রতি অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই এই সময়ের প্রধান কর্তব্য। বাংলাদেশে সেই আন্দোলনের সামনের কাতারে চলে এসেছেন মাহমুদুর রহমান। তাঁকে অভিনন্দন।
রিমান্ড, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন, পুলিশি হেফাজতে হত্যা, আইনবহিভূêত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির বিরুদ্ধে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আদালত এই ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষেই ভূমিকা রাখবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

0 comments:

Post a Comment

  © Blogger template Webnolia by Ourblogtemplates.com 2009

Back to TOP